অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মাস: প্রধান সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের এক মাসের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এক মাসে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে:
মানবাধিকার ও গুম-নির্যাতন:
অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্দোলনে নিহতদের ঘটনা তদন্ত এবং গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত হয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে।
এছাড়া, আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারের জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির ক্ষমার ঘোষণা এসেছে, যা ড. ইউনূসের অনুরোধে বাস্তবায়িত হয়েছে।
সংসদ ও বিচারবিভাগ:
৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন এবং ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগ করেন।
রাজনীতি:
৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাত ও দুর্নীতি দমন:
১০টি ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার:
১৯ আগস্ট সব উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। ১২ আগস্ট চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা:
গণ-আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি:
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ এখন গণশুনানির মাধ্যমে হবে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চুক্তি পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা:
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের জন্য ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
পরিবেশ ও ক্রীড়া:
রামুর সংরক্ষিত বনে টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছে। নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে এবং ফারুক আহমেদ নতুন সভাপতি হয়েছেন।
নির্বাহী আদেশ ও সিদ্ধান্ত:
৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১৩ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মাসে নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে প্রভাব ফেলবে।