বেকার সমস্যা শিক্ষাব্যবস্থার ফসল

ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসন চালাতে প্রয়োজনীয় কেরানিকূল সৃষ্টি করা। একটি দেশে সকল মানুষকে কেরানি বানিয়ে ফেলা কতবড় মূর্খতা তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। ইংরেজদের বিদায়গ্রহণের পরও আমরা সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রয়োগ করে যাচ্ছি এবং বেসুমার কেরানি সৃষ্টি করে যাচ্ছি যা আমাদের দেশে (এবং সমগোত্রীয় দেশগুলিতে) বিরাট বেকারত্ব সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সেই সমস্যার সাগরে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না করতেই পাশ করে বেরোচ্ছেন আরও কয়েক লক্ষ কেরানি। জাতি হাঁসফাস করছে এই শিক্ষিত বেকারের চাপ সামলাতে, কারণ অশিক্ষিত মানুষ কদাচিত বেকার থাকে। তারা যে কোন কায়িক শ্রমের কাজে সম্পৃক্তি হতে দ্বিধা করে না। কিন্তু যখন কারও পোর্টফোলিওতে একটি বা দু’টি সার্টিফিকেট সঞ্চিত হয়ে যায়, তাকে আর কায়িক শ্রমে লিপ্ত করা যায় না। তার পারিপার্শ্বিকতা এবং মানসিকতা তার সামনে হিমালয়ের চেয়ে উঁচু বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মানবসম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশ। কিন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা কোনোভাবেই সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না, মননের তো নয়ই। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অগ্রগতির নির্দেশক না হয়ে সমাজের জন্য অনেকটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা নিয়ে আমরা যতই বাগাড়ম্বর করি না কেন, খুব বেশি এগোতে পারিনি। ব্রিটিশ আমলের কেরানি তৈরি করার শিক্ষারও যে উপযোগিতা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের সেটুকু উপযোগিতা না থাকা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, লজ্জাজনকও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে মোট শ্রমশক্তি ছিল ৭ কোটি ৩৭ লাখ। ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিক শেষে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যা তার আগের প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার জন (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মে ২০২৪)।
এভাবেই বাংলাদেশে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। সেখানে সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র উচ্চ শিক্ষিতদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি সমীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বর হার এখন ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী পূর্ববর্তী ৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ৮ লাখ হয়েছে। করোনা মহামারির আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর তথ্য বলছে দেশে বেকারত্বের হার হচ্ছে ৩.৬ শতাংশ। এরমধ্যে যুব বেকারত্ব প্রায় ৮০ শতাংশ। তাই যে কোনো চাকরিতেই এখন দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়, তার চাইতে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি উদাহরণ দিই। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের (২০২৪) মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণির ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাট-বল্টু টাইট দেওয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান। যদিও সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।
এছাড়া নৈতিক শিক্ষার অভাবে বাংলাদেশীরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কাজ করার সুযোগ হারিয়েছে বা হারাচ্ছে (বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি)। লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি, ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, একজন লেখাপড়া না জানা মানুষ বেকার থাকা আর শিক্ষিত মানুষের বেকার থাকা এক কাতারে ফেলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ তথা জনগণ যে বিনিয়োগ করে থাকে, তার বিনিময়ে যদি আমরা কিছু না পাই, সেটি হবে মস্ত বড় অপচয়।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু কাজ পান মাত্র সাত লাখ। বাকি ১৫ লাখ মানুষ জাতির বোঝায় পরিণত হয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিক শিক্ষিত হোক, এটা জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি, সেই শিক্ষিত জনশক্তিকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো। প্রতিবছর যে লাখ লাখ জনশক্তির আগমন ঘটছে, তাদের কর্মসংস্থান করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতাই কেবল বাড়ছে না, অপরাধ প্রবণতাও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
আমার দেশ (১ জুলাই ২০১২) পত্রিকায় প্রকাশ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গবেষক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা কেরানি তৈরি করছে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আরেক গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকি বিল্লাহ জানান, শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে। পাসের হার বেড়ে যাওয়া মানেই বেকারত্বের হার বাড়া। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকেই শিক্ষিত বেকার তৈরি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে প্রতি বছর সাধারণ শিক্ষায় ৪ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় পাস করে। যাদের অধিকাংশ চাকরির আশায় থাকে এবং চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ৬/৭ বছর পর্যন্ত বেকার থাকে। তারা বিশেষ কোনো কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায় এদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে গিয়ে অন্যান্য দেশের মাধ্যমিক পাসকারীদের অধীনে চাকরি করে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া শেষ করার পর তাকে কোনো কাজ বা চাকরি করা উচিৎ সে সম্পর্কে কোনো দিক নির্দেশনা দেয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানে জব কাউন্সিলিং না থাকার কারণে শিক্ষার্থী বুঝতে পারে না সে কোন কাজ করার যোগ্যতা রাখে।
এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি ব্রিটিশ শাসনের যুগেই জাতির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উনবিংশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন হওয়ার পরে আমাদের সমাজে এই ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি গড়ে ওঠে। এই সমাজের মানসিক স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯৪৮ সনে শ্রী প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন, “এ সময় বাঙলা দেশে দ্রুত একটা মধ্যবিত্তশ্রেণী গড়িয়া উঠিল। ইহা একাধারে ইংরাজশাসনের কীর্তি ও অপকীর্তি, একাধারে ইহাই তাহার প্রতিষ্ঠা ও বিনাশের কারণ। মধ্যবিত্ত চাকরিগতপ্রাণ শ্রেণির সাহায্যেই ইংরাজ এদেশে শাসন করিয়াছে-অবশেষে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ইংরাজশাসনে বীতরাগ হইয়া তাহার প্রতিষ্ঠার প্রথম ইষ্টকখানা টানিয়া ফেলিয়া দিয়া বৈদেশিক শাসনের বেদীকে শিথিল করিয়া দিল। বাঙালী সন্ত্রাসবাদীগণের সকলেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক।
এখন অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মান-মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা আর পূর্ববৎ নাই, ব্যাপক যন্ত্রশিল্পের প্রসারের ফলে তাহাদের প্রভাব প্রতিদিন কমিতে থাকিবে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লইয়া বাঙলা দেশের বিশেষ সমস্যা। বাঙলার বিশিষ্ট সমস্যা লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত, নানাগুণে কৃতী, অধুনা অসহায় ও অসন্তুষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইহারাই একদা ভারতবর্ষে ইংরাজশাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করিয়াছে, বাঙালীর সংস্কৃতির মুখোজ্জ্বল করিয়াছে এবং ইংরাজশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছে! এখন ইহারা ক্লান্ত এবং জীবিকা অর্জনে অক্ষম প্রায়। এখন ইহারা ‘উব-সড়নরষরংবফ’ সৈন্যের মত অসহায়ভাবে ঘুরিয়া মরিতেছে। কর্তৃপক্ষ ইহাদের ভাবেন অবাঞ্ছিত, সাধারণে ভাবে অতিরিক্ত, আর ইহারা নিজেদের ভাবে অভিশপ্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুষ্ঠু সমাধান না ঘটিলে ইহারা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইতে দিবে না, হয়তো সেই অশান্তির ফলে আবার শাসনবেদীর ইট খসিয়া পড়িতে আরম্ভ করিবে। ইহাদের প্রত্যেকেই থলিতে সম্ভাবিত লাল নিশান গুপ্তভাবে অবস্থান করিতেছে।
আজ এই যে অবস্থায় আমরা আসিয়া পৌঁছিয়াছি, ইহার মূল হেয়ারের পাঠশালায় এবং হিন্দু কলেজের পাঠ্য গৃহে। সেকালে ইংরাজী শিখিলেই চাকরি জুটিত, লাট সাহেব ডাকিয়া ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতেন; কেহ বলিত মাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, কেহ বলিত বাবার মত জানিয়া জানাইব, আবার কাহাকেও অনুরোধ করিলে বলিত অ-গঙ্গার দেশে মা যাইতে দিতে রাজি নন। সেকালে চাকরিদাতাই উমেদার ছিলেন। একালে ইংরাজী জানা দূরের কথা, ইংলিশ চ্যানেল গিলিয়া খাইলেও চৌকিদারটাও ফিরিয়া তাকায় না। সেকালের সমাধান-একালের সমস্যায় পরিণত। সেকালের জ্ঞান-কৈবল্যের তীক্ষ্ম তরবারি একালের কর্মহীন বাঙালীর হাতে পড়িয়া কেবল চুল চিরিবার চেষ্টা করিয়া দলে দলে ‘অমিত রায়ের’ সৃষ্টি করিতেছে।” (চিত্র-চরিত্র- শ্রী প্রমথনাশ বিশী)। বাক্যবাগীশ অমিত রায়ের ‘দুর্দান্ত স্মার্ট’ চলনবলন সম্পর্কে রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন।
কেরানিগিরি একটি একঘেয়ে কাজ, এতে কোন সৃজনশীলতা নেই। ব্রিটিশ আমলে ফটোকপি মেশিন না থাকার যুগে কেরানিরা দলিল-দস্তাবেজ দেখে দেখে হুবহু কপি করতেন বলে এর ইংরেজি প্রতিশব্দে রাইটার শব্দটি ঢুকে গেছে। কলকাতার সচিবালয়কে বলা হয় রাইটার্স বিল্ডিং। এক কেরানি হুবহু কপি করতে বসে বিপদে পড়েছিলেন, একটি শব্দের ওপর মাছি মরে লেপ্টে গিয়েছিল। তিনি কিছুতেই শব্দটি বুঝতে পারছিলেন না। শেষতক বুদ্ধি খাটিয়ে বের করলেন, একটি মাছি মেরে কপিতে লেপ্টে দেবেন। তিন দিন ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি একটি মাছি মারলেন এবং সেটি জায়গামতো লেপ্টে দিলেন। একেবারে হুবহু কপি যাকে বলে! কথিত আছে- এ থেকেই বাংলায় ‘মাছি মারা কেরানি’ প্রবাদটির সৃষ্টি। কৃশানু ভট্টাচার্যের একটি লেখা থেকে এ তথ্যটি জানা গেল। কেরানি নিয়ে ব্রিটিশ আমলে জরিপও হয়েছে! বিখ্যাত সিভিলিয়ান, সাংবাদিক, শক্তিশালী লেখক, বড়লাটের শাসনপরিষদের সদস্য এবং পরামর্শদাতা সর্বোপরি ব্রিটিশ সরকারের Director General of Statistics হান্টার সাহেব এই জরিপের কাজটি করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৮৭০ সালে কেরানির সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৪৭ জন। ১৮৮১ সালে তা পৌঁছায় ১৬ হাজার ৩১৫-তে। তারও ১০ বছর বাদে ১৮ হাজার ৯৫০-এ। এভাবে উত্তরোত্তর কেরানির সংখ্যা বৃদ্ধিই বোধ হয় বাঙালির কেরানি মানসিকতার বদনাম তৈরি করেছিল। ১৮৮৬-তে উইলিয়াম হান্টারকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর করা হয় এবং তিনি এডুকেশন কমিশনের প্রেসিডেন্টের পদটিও পেয়েছিলেন। দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই যে বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার একান্ত বন্ধু মি. হাডসনের নামে- সেই হাডসন যিনি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের রাজবাড়ির ২৯টি কচি বাচ্চা হত্যা করে তাদের কাটা মাথা ঝুড়িতে সাজিয়ে উপহার দিয়েছিলেন বৃদ্ধ বাদশাহকে।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেরানি শব্দটি আমাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়ের প্রতীক। কেরানি মানে অধীনস্থ, পরাধীন, চিন্তাহীন একজন মানুষ। তার কোনো অধিকার থাকবে না মতামত দেওয়ার। বোধ থাকবে না। সে শুধুই অপরের আজ্ঞাবহ। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে বলতেন আমেরিকার কেরানি। তিনি বলতেন, কেরানির সঙ্গে কিসের আলোচনা! তাকে একবার আলোচনার জন্য ডাকাও হয়েছিল। কিন্তু আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেন তিনি। আমাদের দেশি বিষয়ে আমেরিকার কেরানির কী মত থাকতে পারে, এ নিয়ে তিনি দ্বিধায় ছিলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের ব্যাপারে কেরানির মত নেওয়ার কথা শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকের সাহসী উচ্চারণ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রনায়করা এতটাই মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছেন যে তারা ব্রিটেন-মার্কিন রাষ্ট্রদূতদেরকে দিবানিশি তোয়াজ করে চলেন। রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান ব্যক্তিরা নির্বাচনের আগে নির্বাচনে জয়ী হলে তারা কেমন সরকার গঠন করবেন সেই রূপরেখা জনগণের সামনে পেশ করার আগে পেশ করেন বিদেশের রাষ্ট্রদূতগণের বরাবরে (খবর- মানবজমিন, ১৩/০৮/১৩), কারণ তাদের ধারণা ইউরোপ-আমেরিকার দূতরাই তাদের ভাগ্য বিধাতা।